স্বামীর মৃত্যুর শোকে কাতর মারুফা তার নিজের দেহে করোনাভাইরাস বহনের খবর শুনেও কাঁদল না। অদূরে দাঁড়ানো অসহায় মাকে অবাক করে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠল সে।
মারুফার মায়ের চোখে পানি। তিনি আঁচলে মুখ ঢেকে পেছন ফিরলেন। তারপর আরও দূরে গিয়ে ‘আল্লাহ গো….’ বলে গগনবিদারী চিৎকারে পুরোবাড়ি কাঁপিয়ে তুললেন। যুবতী মেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে সন্দেহ হলে কোন মা ঠিক থাকতে পারে?
মারুফা এক সপ্তাহ যাবত ঘরবন্দি। মা-ও, বাড়ির আলাদা ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। স্ট্রোক করে বাবা যে বছর মারা গেলেন, মা ঘরবন্দি ছিলেন ৪০ দিন। মারুফা তখন স্কুলের ছাত্রী। পাড়াপড়শিরা তো আসতোই, মাকে সহানুভূতি জানাতে দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়-স্বজনরা এসেছিল। তারা শুধু মুখের স্বান্তনা দেয় নি, স্বামীহারা মায়ের ডজনখানেক নতুন শাড়ির উপলক্ষও হয়েছিল। আর মারুফা? প্রবাস ফেরত স্বামীর মৃত্যুতে বুকে পাথর চেপে বসে আছে। কেউ দেখতে আসবে তা নয়, উলটো বাড়ির আশেপাশের মানুষদের সাথেও মিশতে ভয় পাচ্ছে। পাছে তারাও করোনা আক্রান্ত হয়। ওর স্বামীর মৃত্যুর পর পুরো উপজেলা লকডাউন করা হয়েছে।
স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে মারুফা অসহায়ই হয় নি, এখন নিজে কভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ায় তার পৃথিবীটা ভয়ানক ছোট হয়ে আসল। পাড়াপড়শিরা ভয়ে দূর থেকে আরও দূরে সরে গিয়েছে। আত্মীয়-স্বজনরা চাইলেও এই গ্রামে আসা অসম্ভব। রাস্তাঘাট বন্ধ। রাস্তা খোলা থাকলেই বা আসতো কি না কে জানে? সবাই এখন নিজের জান বাঁচাতে ব্যাস্ত। শ্বশুরবাড়ির মানুষজন এক-দুই দিন ফোনে খোঁজ নিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। বড় ছেলেকে হারিয়ে শ্বশুর-শাশুরি হয়তো পাগল প্রায়।
মারুফার এই দুঃসময়ে পাশে থাকার মতো একমাত্র মানুষ মা ছায়েরা বানু। তিনি ২৪ ঘণ্টা কান্নাকাটির মধ্যে আছেন। একমাত্র মেয়ের অকাল বৈধব্য তাঁকে অস্থির করে রেখেছে। তাও মারুফাকে তিনবেলা রান্না করে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি। অক্ষরজ্ঞানহীন ছায়েরা মেয়েকে স্বান্তনা দিতে কাছে আসার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মারুফার বাধায় কাছে ঘেঁষতে পারেননি। মারুফা বলেছে ওর কাছে আসলে করোনাভাইরাস ছড়াবে। ‘আইএ পাস’ মেয়ের যুক্তির কাছে স্নেহপ্রবণ মা পরাস্ত। মাকে বোঝানোটা এত সহজ ছিল না। হাসিখুশি শান্ত মেয়ে মারুফাকে খারাপ আচরণ পর্যন্ত করতে হয়েছে মায়ের সাথে। ধারালো বটি কাছে না রাখলে ছায়েরা বানু হয়তো বারবার ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতেন।
রোদের তেজ বাড়ছে। পহেলা বৈশাখের দুপুরের রোদ, অসহ্য। ঘরের পেছনের গাছে একটা কাক ডাকছে। অনেক দিন পর কাকের ডাক শুনতে পেল মারুফা। আশ্চর্য এতদিন গ্রামে কাক দেখায় যাচ্ছিল না। কী অজানা কারণে গ্রামে কাক কমে গেছে। আজ কী দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে এল এই কাক! মারুফা আপন মনে হাসে- তুই আর কি দুঃসংবাদ দিবি রে কাওয়া! মারুফার এর থেইক্যা বেশি দুঃখ পাওনের কিছু নাই।
সাফু কাছাকাছি আছে কি না কে জানে? সে অস্ফুট স্বরে ছোটভাই সাইফুলকে ডাকার চেষ্টা করে- সাফু, ও সাফু। ও ভাই, দেখ গিয়া আম্মারে বুঝাইয়া থামাইতে পারস কি না। আচ্ছা ভাই তুই-ই ক, কাইন্দা-কাইট্টা কোনো লাভ অইব? যা অইবার তো অইছেই। যা অইবার অইবই। আম্মারে কসনা কান্দা থামাক।
মারুফা কথা থামাতেই কাকটা আবার ডাকছে- কা, কা। এখন খেয়াল হলো সে ভুল বকছে। সাইফুল মালয়েশিয়ায় গেছে দেড় বছর হলো। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরতে তার কৈশোর পেরুনো ভাইটি বিদেশ চলে গেছে। এজন্য পাসপোর্টে বয়স বেশি দেখাতে হয়েছে। বাড়ির ছোট-বড় সমস্যা সাইফুলকে জানানো হয়না দুশ্চিন্তা করবে বলে। কিন্তু এবার ইতালি থেকে সাজিদ মিয়ার দেশে ফেরা, পরিবারের সবার হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা, এমনকি সর্দিকাশিতে সাজিদের আকস্মিক মৃত্যুর সব ঘটনাই জানানো হয়েছে ওকে। সাইফুল ওর দুলাভাইয়ের মৃত্যুতে ধাক্কা খেলেও ভেঙে পড়েনি। উল্টো মা-বোনকে ফোনে বারবার সতর্ক করেছে আলদা আলাদা থাকার ব্যাপারে। জানিয়েছে মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থাকায় ও নিজেও সতর্ক ভাবে আছে। মারুফা টের পায় জীবনসংসারের কঠিন বাস্তবতা তার সহজসরল কিশোর ভাইটিকে এক লাফে দায়িত্বশীল মানুষ বানিয়ে দিয়েছে।
কাকটা গাছ ছেড়ে ঘরের চালে চলে এসেছে। ডাকছে আগের মতোই। মায়ের কান্নার শব্দ কমেছে। মারুফা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। নিজেকে ব্যাঙ্গ করে- মারুফা, ও মারুফা তুমি ডরাইস? ডরাইয়োনা গো কইন্যা, ডরাইয়োনা। আন্ধার রাইতের পরে সুন্দর দিন আসে সেকি তুমি জাননা! মারু, ও মারু তোমার কি হইসে! জামাই মরসে? দুঃখ কইরোনা। দুনিয়ার কতো মানুষই তো করোনায় মরতাসে। হেরা কি মরণের লাইনে থাকা লোকগুলোরে বাঁচাইয়া রাখতে পারতেসে? আর এইডা তো বাংলাদেশ। আমার জামাই না অয় পুলিশ রে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ দিয়া এয়ারপোর্ট পাইর অইয়া আইসে। মরসে। অহন আমারেও মরণের বাও করছে। অন্য মাইনষে? হেরা কি দোষ করসে? হেরার করোনা অইল কেন? মারু, ও মারু, উত্তর দেও। জানি তুমি উচিৎ কথা কইবা না। না কও অসুবিধা নাই। আমি বুঝি। একটু অইলেও বুঝি। হা হা হা৷
সদ্যমৃত সাজিদ মিয়া তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে মারু ডাকতো। স্ত্রীকে খুব ভালোবাসত। এজন্যই ইতালি থেকে ফিরে সোজা শ্বশুরবাড়ি এসে উঠেছিল। বাপ-মাকে রাজি করিয়েছিল বিশেষ কৌশলে। ঢাকা থেকে ফিরতে মারুফাদের এলাকা আগে পড়ে। তাই সাজিদের বাবা আপত্তি করেন নি। কথা ছিল পরদিন নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে ও। সাথে মারুফাকেও নিয়ে যাবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে স্ত্রী ও শাশুরিসহ চৌদ্দ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে শুরু করল। নয়দিন পর শুরু হলো সাজিদের সর্দিকাশি আর জ্বর। এগারো দিনের দিন শ্বাসকষ্ট। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিতে নিতে সব শেষ। এরমধ্যেই পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকার আইইডিসিআর-এ পাঠিয়েছিল স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন। সাজিদের মরার তিনদিন পর জানা গেল তার করোনা পজিটিভ ছিল, মৃত্যু হয়েছে কভিড-১৯ রোগে।
মারুফাকে সাজিদ জানিয়েছিল ঢাকায় কোয়ারেন্টাইনের ঝামেলা এড়াতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পুলিশকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে এসেছে সে। এতগুলো টাকা ঘুষ দিয়েছে শুনে রাগ করলেও স্বামীকে কাছে পেয়ে মনে মনে খুশিই হয়েছিল মারুফা।
রোদ বাড়ছে। কয়েক দিনের কান্নাকাটিতে মারুফার ফুলে ওঠা চোখ থেকে নোনা পানি বাষ্পের মতো উড়ে গিয়েছিল আগেই। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল জনমানবহীন এক রাস্তা। ছোটবেলায় দেখা দীর্ঘ গোপাটের মতো রাস্তা।
কাঁচা রাস্তাটির দু’পাশে শেউরা গাছের ঘন সারি। ভরদুপুরেও রাস্তায় আলো-আঁধারি খেলা চলছে।
অন্যমনস্ক মারুফা টলমল পায়ে বাড়ির অদূরের রাস্তায় যেতেই পত পত শব্দ তুলে শেউড়া গাছ থেকে উড়ে গেল একদল শাদা বক। ওরা এই গাছগুলোয় বাসা বানিয়েছে? নাকি পাশের হাওর থেকে মাছ খেয়ে ভরপেটে বিশ্রাম নিতে আসে এই ঘনসবুজ শেউড়া গাছের ছায়ায়? বকের দলের উড়ে যাওয়ার পথে মাথা তুলে তাকাতেই চোখ বন্ধ হয়ে এল ওর। কুঁচকে গেল কপাল। ভরদুপুরের রোদে যা ঝাঁঝ! মাথাটা কি চক্কর দিয়ে উঠল?
চোখেমুখে কয়েকবার ঠান্ডা পানির ঝাপটা পড়তেই চেতনা ফিরে এল সদ্য স্বামীহারা মারুফার। আধাপাকা ঘরের বারান্দায় নিজেকে আবিষ্কার করল সে। অদূরে দাঁড়িয়ে আছে ওর মাঝবয়সী মা। এক হাতে প্লাস্টিকের নীল জগ, অন্য হাত আঁকড়ে ধরা ঘরের বারান্দার পিলার।
মারুফা বুঝতে পারে, সে জ্ঞান হারিয়েছিল।
মা কি মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন? ও আল্লাহ এখন কি করা? মা জ্ঞান হারাচ্ছেন? তার তো হাই ব্লাড প্রেসার। এখন কি হবে? বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষও নাই যে ডাকবে? পাশের বাড়ির কাউকে ডাক দিবে? কিন্তু ডাকলেই বা কে আসবে এই নিদারুণ কালে। দুনিয়ায় হাশরের মহরা চলছে না! সবাইকে ‘ইয়া নফসি’, ‘ইয়া নফসি’ জপতে হচ্ছে এখন। অদৃশ্য এক করোনাভাইরাসের ভয়ে কাঁপছে পৃথিবীর মানুষ।
মারুফা করোনাভাইরাসের কথা ভুলে মাকে তুলতে যেতে চায়। কিন্তু নড়ার শক্তি পাচ্ছেনা সে। তীব্র শীত অনুভব হচ্ছে। শুকনো কাশিটা আবার শুরু হয়েছে।
মারুফার এখন কান্না পাচ্ছে। মাকে সাহায্য করা দরকার, কিন্তু পারছেনা।
শাদা বকের মতো পোশাক পড়া পাঁচজন লোক এসেছে বাড়িতে। সাথে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিক কাকা। লোকটার পড়নে চেনা সেই পাঞ্জাবি আর মুখে আধাপাকা দাড়ি না থাকলে চিনতেই পারতো না সে। চেয়ারম্যান নিজের মুখের মাস্ক ঠিক করতে করতে দ্রুত মারুফার মায়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। পাশে থাকা জগের অবশিষ্ট পানি ঝাঁপটা দিয়ে চেতনা ফেরালেন ছায়েরার। মারুফা সেদিকে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণে খেয়াল হল মায়ের পরনে আজ শাদা শাড়ি।
শাদা পোশাকে পুরো শরীর ঢাকা লোকগুলো মারুফাকে উঠে আসার তাগাদা দিল। মুখে মাস্ক আর চোখে চশমা থাকায় তাদের চেহারা চেনা যাচ্ছেনা। মারুফা জানে ওকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে।
মাকে সাথে যেতে দেবে না। মা কোথায় থাকবে? মায়ের কথা ভেবে ওর ভেতরটা কেঁপে উঠল। ঢাকার হাসপাতালে একা কিভাবে থাকবে সে? হাসপাতালেই বা কয়দিন থাকতে পারবে, যদি স্বামীর মতো মরে যেতে হয়! ভাগ্য ভালো হলে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে, তখন মাকে কোথায় খুঁজবে সে?
মারুফা মুচকি হাসল। ওর মনে পড়ল একটু আগে অচেতন অবস্থায় দেখা শাদা বকগুলোর কথা। আহা মানুষের জীবন বক পাখির মতো হলে কত ভালো হতো। মায়ার বাঁধন বলে কিছু নাই, বলতে গেলে সবাই স্বাধীন। বক কি সুন্দর বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ছানা ফোটায়। ছানাগুলো উড়তে শিখলে আলাদা বাসা বাঁধে। তখন কোথায় থাকে বাবা-মা আর কোথায় থাকে পরিবার। বক সমাজে কি মানুষের মতো মায়া-মমতা আছে!
মারুফা মাথা তুলে দাঁড়ালো। শাদা পোশাকের লোকগুলো ওকে নিয়ে যেতে প্রস্তুত। বাড়ির সামনের সরু সড়কে এম্বুলেন্স দাঁড়ানো। মা আবার কাঁদছেন।
মারুফার ইচ্ছে করছে সে শাদা বক হয়ে উড়ে যায়।
সোহরাব শান্ত
লেখক, কলামিস্ট